শরিয়াহ মোতাবেক ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠন
ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনে ইসলামের ভূমিকা : আলোচ্য শিরোনামে পরস্পর সম্পৃক্ত তিনটি বিষয় পাওয়া যায়। (ক) ব্যক্তি, (খ) পরিবার, ও (গ) সমাজ এবং এ তিনটি বিষয়েই সফলতা অর্জনের জন্য ইসলাম সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। যেমন :
ক. ব্যক্তি:
একথা সুস্পষ্ট যে, একজন মানুষ মুসলিম হওয়া নিঃসন্দেহে বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। ইসলামই আমাদের মর্যাদার প্রতীক। এর মাধ্যমেই এ পার্থিব জগতে যেমন শান্তি ও সাফল্য পাওয়া যাবে ঠিক তদ্রুপ পরকালীন জীবনে পাওয়া যাবে জাহান্নাম থেকে মুক্তির নিশ্চয়তা। কিন্তু আজকে আমরা অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ের ইসলামী সৌন্দয্যের দিকগুলো জানিইনা। যার কারণে তার মাঝে ইসলামী ব্যক্তিত্বের ছোয়া পরিলক্ষিত হয় না। একজন মুসলিমের ব্যক্তিত্ব কেমন হওয়া উচিৎ এ ব্যাপারে নিম্নে কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরা হলো :
০১. মুসলিম ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা কখনই বলবে না।
০২. সে কখনো প্রত্যারণার আশ্রয় নিবে না বরং সে হবে বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন।
০৩. সে অগোচরে কারো সমালোচনা করবে না এবং কারো সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করবে না।
০৪. সে হবে সৎ-সাহসী, কাপুরুষতাকে সে ঘৃণা করবে।
০৫. ন্যায়ের পক্ষে সে অত্যন্ত দৃঢ়তার পরিচয় দিবে। সত্য ও বাস্তব ব্যাপারে দ্বিধাহীনভাবে নিঃসংকোচে কথা বলবে।
০৬. সে হবে নিষ্ঠাবান যদিও এতে তার ক্ষতি হয় বা তার বিপক্ষে যায়।
০৭. সে অন্যের অধিকারে কখনো হস্তক্ষেপ করবে না।
০৮. কেউ তার উপর অন্যায় বা জুলুম করলে তাও সে মেনে নিবে না।
০৯. সে হবে শক্তিশালী।
১০. মুসলিম ব্যক্তি সব কাজে বিজ্ঞজনদের পরামর্শ নিবে। আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে মহান আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকবে।
১১. সে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাসাধ্য পূর্ণাঙ্গরূপে পালন করবে।
১২. সে হবে বিনয়ী এবং দয়ালু।
১৩. সে সব সময় ভালো এবং জনকল্যাণমূলক কাজ নিজে করবে এবং অন্যকে তা করার প্রতি উৎসাহিত করবে এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকবে এবং অন্যকে তা থেকে নিষেধ করবে।
১৪. সে আল্লাহর দ্বীনের কাজে সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
১৫. একজন মুসলিম নারী হিজাব পরিধান করবে এবং পর-পুরুষের সামনে নিজেকে পূর্ণাঙ্গরূপে ঢেকে রাখবে।
সর্বশেষ আমরা সূরা হুজরাতের ৯ থেকে ১৩ আয়াত পর্যন্ত তেলাওয়াত করলেই একজন মুসলিম ব্যক্তির উন্নত জীবন গঠনের সকল পাথেয় পেয়ে যাব।
খ. ইসলামী পরিবার
যে পরিবার ইসলামী ভাবধারা, ইসলামী নীতিমালা ও ইসলামী বিধি-বিধানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং পরিচালিত হয় তাকেই ইসলামী পরিবার বলে।
মানব সমাজ গঠনের মৌলিক উপাদান হলো পরিবার। পরিবারের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে আপন বংশ পরিক্রমা, তাই আখলাক ভিত্তিক পরিবার গঠনের প্রতি ইসলাম খুবই গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
একটি আখলাকী পরিবারের মধ্যে নিম্নোক্ত গুণাবলি চাই :
০১. আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন পরিবার : পবিত্র কুরআনে এসেছে, তার নিদর্শনাবলির একটি হলো, তিনি তোমাদের জন্য স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাদের কাছে তোমরা প্রশান্তি লাভ কর। তিনি তোমাদের উভয়ের মধ্যে তৈরি করেছেন ভালোবাসা ও মায়া-মমতা, নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য অনেক নিদর্শন আছে। (সূরা রুম ২১)
০২. পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধন থাকা : ইসলামে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে সুদৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে। তা সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণেই বিনষ্ট হয় না, তাই তুচ্ছ কোনো কারণে পারিবারিক ভিত্তি ভেঙ্গে ফেলা উচিত নয়, আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা তাদের (স্ত্রী) অপছন্দ কর, তাহলে স্মরণ রেখো হয়তো তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করছ, যাতে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য কল্যাণ রেখেছেন। (নিসা-১৯)
০৩. পারিবারিকভাবে আমল চর্চা করা : সুদৃঢ় ঈমান ও সৎ আমলের মাধ্যমে পারিবারিকে ভিত্তি মজবুত হয়। পারস্পরিক মায়া-মমতা বেড়ে যায়। আমলের প্রতি গুরুত্বারোপকারী পরিবারের জন্য নবীজী (স) অনেক দোয়া করেছেন। নবীজী (স) বলেন, মহান আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর রহম করুন যে রাতে উঠে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে। তার স্ত্রীকেও ডেকে দেয়। সেও নামাজ পড়ে। যদি স্ত্রী নামাজ পড়তে না চায় তার চেহারায় পানির ছিটা দেয়। আল্লাহ ঐ নারীর উপর রহম করুন, যে রাতে উঠে নামাজ আদায় করে। (আবু দাউদ)
০৪. সন্তানদের ইসলামের নির্দেশনা শিক্ষা দান : পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে আল্লাহর বিধি-নিষেধ শিক্ষা দেয়া জরুরী, তখন পরিবারের সন্তানরা আল্লাহর প্রতি অবিচল ঈমান নিয়ে বেড়ে উঠবে। আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুণ থেকে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। (তাহরিম-৬)
৫. নবী ও আহলে বাইতের ভালোবাস শিক্ষা দান : হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবীজী (স) বলেছেন : তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বৈশিষ্ট্য শিক্ষা দাও। এক. নবীর ভালোবাসা, দুই. নবীর আহলে বাইতের ভালোবাসা, ও তিন. পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত। (দায়লামী)
গ. সমাজ
আখলাকভিত্তিক সমাজ গঠনের গুরুত্ব ইলামে অপরিসীম। কারণ সমাজের মানুষ পরস্পরের উপর মুখাপেক্ষী। তাই পরস্পরের আখলাক ভাল হলে ঐ সমাজটি উন্নত সমাজ হবে। উন্নত সমাজের গুণাবলি নিম্নরূপ :
০১. আল্লাহর সার্বভৌমত্ব : উত্তম সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে এই সমাজের লোকেরা সকল কাজে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব করবে না। জীবনের সকল দিক ও বিভাগে কিতাব ও সুন্নাতের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করবে।
০২. নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য : উত্তম সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট হল আনুগত্যশীলতা। নবীজী (স) বলেন, মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হল পছন্দনীয় ও অপছন্দনীয় সকল কর্মে আদেশ শ্রবণ করা ও মান্য করা। যতক্ষণ না কোন পাপকর্মে আদেশ করা হয়। যদি কোন পাপকর্মে আদেশ করা হয় তাহলে কোন আনুগত্য নেই। (তিরমিযি)
০৩. পরামর্শ গ্রহন : সমাজ পরিচালনায় যোগ্য ও উত্তম ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ অপরিহার্য, আল্লাহ বলেন, তুমি প্রয়োজনীয় বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। (ইমরান ১৫৯)
০৪. দায়িত্বশীলতা : উত্তম সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পারস্পরিক দায়িত্বশীলতা। সমাজের প্রত্যেক সদস্য পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করবে। নবীজী (স) বলেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। (মেশকাত)
০৫. উত্তম চরিত্র : উত্তম সমাজের প্রত্যেক সদস্যই হবেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। একে অপরের প্রতি হবে বিশ্বস্ত। নবীজী (স) বলেন, কিয়ামতের দিন মুমিনের দাড়িপাল্লায় সর্বাধিক ভারী হবে তার উত্তম চরিত্র। (তিরমিযি)
আমাদের কার্যক্রমসমূহঃ